মেহেরপুর ৭১, ২৩ অক্টোবর:
আজ ২৩ অক্টোবর স্থানীয় শহীদ রোভার দিবস। প্রতি বছরের ন্যায় ৫ রোভারের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে মেহেরপুর জেলা রোভারের উদ্যোগে যথাযোগ্য মর্যাদায় শহীদ রোভার দিবস পালিত হয়েছে। করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে আলোচনা সভা না করা হলেও ৫ রোভারের ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে ৬ টায় মেহেরপুর পৌর কবরস্থানে কবর জিয়ারত শেষে সকাল ৭ টায় কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিল প্রাঙ্গণে অবস্থিত মেহেরপুর জেলা স্কাউট ভবনের সামনে রোভার স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। মেহেরপুর জেলা রোভারের কমিশনার ও সরকারি মহিলা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রফেসর রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে এসময় সেখানে বক্তব্য রাখেন সাবেক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন, বর্তমান সম্পাদক ফররুখ আহমেদ, শহীদ রোভার জাভেদ ওসমনের পিতা শফি উদ্দিন, নুরুল আহমেদ প্রমূখ। এছাড়াও অন্যদের মধ্যে শহীদ রোভার মনিরুলের পিতা আব্দুস শহীদ, শহীদ রোভার মাহফুজের পিতা জেলা রোভরের কোষাধ্যক্ষ রমজান আলী প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন। পরে বিকাল ৩ টায় মেহেরপুর সরকারি কলেজ জামে মসজিদে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। মেহেরপুর জেলা স্কাউটসের সাধারণ সম্পাদক ফখরুখ আহমদ উজ্জল জানান, করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে আলোচনা সভা না করা হলেও সকাল সাড়ে ৬ টায় কবর জিয়ারত, সকাল ৭ টায় কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিল প্রাঙ্গণে অবস্থিত স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং বিকাল ৩ টায় মেহেরপুর সরকারি কলেজ জামে মসজিদে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। ১৯৯৭ সালের আজকের এই দিন মেহেরপুরের জন্য এক বিভীষিকাময় দিন। সকাল হতেই এক মর্মান্তিক খবরে জেলাব্যাপী শোকের ছায়া নেমে আসে। সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগান সংলগ্ন গলফ ক্লাব অ্যারিনায় ৯ম এশিয়া প্যাসিফিক/৭ম বাংলাদেশ রোভার মুটে অংশ নিতে মেহেরপুর থেকে ছেড়ে যাওয়া রোভার স্কাউটের বাসটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। আর এতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হোন ৫ জন রোভার। আহত আরো ১৯ জন রোভার। রোভাররা হলেন- শহীদ জাভেদ ওসমান, শহীদ মনিরুল ইসলাম, শহীদ মাসুম হোসেন, শহীদ মুন্সী আমিনুল ইসলাম ও শহীদ মাহফুজুর রহমান মাহফুজ। তাঁদের মধ্যে শহীদ জাভেদ ওসমান, শহীদ মনিরুল ইসলাম ও শহীদ মাসুম হোসেন ছিলেন মেহেরপুর শহরের। শহীদ আমিনুল ইসলামের বাড়ি মুজিবনগরের দারিয়াপুর গ্রামে এবং শহীদ মাহফুজুর রহমান ছিলেন সদর উপজেলার উজলপুর গ্রামের। বাংলাদেশ স্কাউটের ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘রোভার’ এপ্রিল সংখ্যার মূল প্রতিবেদন ছিল মেহেরপুরে শহীদ রোভারদের নিয়ে। ‘ডেডলাইন মেহেরপুর’ শিরোনামে সেই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২৪ অক্টোবর থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগান সংলগ্ন গলফ ক্লাব অ্যারিনায় অনুষ্ঠিত ৯ম এশিয়া প্যাসিফিক/৭ম বাংলাদেশ রোভার মুটে যোগদানের জন্য মেহেরপুর জেলার মেহেরপুর সরকারি কলেজ, মুজিবনগর কলেজ, মুন্সী মেহেরুল্লাহ মুক্ত রোভার স্কাউট গ্রুপ, মুন্সী জমির উদ্দীন মুক্ত রোভার দলের ৩২ জন রোভার স্কাউট ও ৪ জন রোভার লিডার (শিক্ষক) সহ ৩৬ জন একটি ভাড়াকৃত বাসযোগে (বাস নং- মেহেরপুর জ-০৪-০০১৫) ২২ অক্টোবর রাত ৮ টার সময় মেহেরপুর থেকে যাত্রা শুরু করে। বাসটি ২৩ অক্টোবর ১৯৯৭ ভোর ৫টা ১০ মিনিটে ঢাকার অদূরে ধামরাই থানাধীন জয়পাড়া নামক স্থানে চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। দুর্ঘটনাস্থলেই ৫ জন রোভার স্কাউটের মৃত্যু ঘটে। এছাড়া ১৯ জন রোভার আহত হয়। তার মধ্যে ১৭ জনকে ধামরাই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। একজনকে তাৎক্ষণিকভাবে ধামরাই থানা কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় মেহেরপুর সরকারি কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র রোভার ফারুক হোসেনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশ স্কাউটস এর প্রধান জাতীয় কমিশনার মনযূর উল করীম বিষয়টি স্বরাষ্ট্র সচিবকে অবহিত করেন। তিনি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, জেলা প্রশাসক, ঢাকা এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপাধ্যক্ষের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করেন। এছাড়া তিনি মেহেরপুর জেলা প্রশাসকের সাথে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে আলোচনা করেন। মনযূর উল করীম দুর্ঘটনার সংবাদটি সাথে সাথেই রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি ও চীফ স্কাউট বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, বৃটেন সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া শোক প্রকাশ করেন এবং শোকবার্তা প্রেরণ করেন। বাংলাদেশ স্কাউটসের উদ্যোগে তাৎক্ষনিক দুর্ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের অ্যাম্বুলেন্স এবং পিকআপ ভ্যান প্রেরণ করা হয়। নিহত ৫ জন রোভারের মৃতদেহ প্রথমে বাংলাদেশ স্কাউসের জাতীয় সদর দপ্তরে আনা হয়। এরপর মৃতদেহগুলি পোস্টমর্টেমের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বাংলাদেশ স্কাউটসের প্রধান জাতীয় কমিশনারের ব্যক্তিগত চেষ্টায় অল্প সময়ের মধ্যেই ৫ জন রোভারের মৃতদেহের পোস্টমর্টেম ও গোসল সম্পন্ন করে কফিনে রাখা হয়। এই সকল কাজের তদারকি করেন বাংলাদেশ স্কাউটসের প্রধান জাতীয় কমিশনার মনযূর উল করীম, রোভার অঞ্চলের আঞ্চলিক উপ-কমিশনার (প্রশাসন) নির্মল কান্তি মিত্র, আঞ্চলিক উপ-কমিশনার (গবেষণা ও মূল্যায়ন) প্রফেসর মোহাম্মদ আব্দুস সালাম, জাতীয় উপ-কমিশনার (সমাজ উন্নয়ন) মিহির কান্তি মজুমদার। কফিন তৈরীর হওয়ার পর নিহতদের আত্মীয়গণের নিকট হস্তান্তরের জন্য ফায়ার সার্ভিসের পিকআপ ভ্যান যোগে মেহেরপুর জেলা রোভার স্কাউটসের সভাপতি জেলা প্রশাসকের নিকট প্রেরণ করা হয়। বাংলাদেশ স্কাউটসের ব্যবস্থাপনায় একটি বাস ও একটি মাইক্রোবাসে করে অন্য সকল রোভার ও মেহেরপুর থেকে আগত আত্মীয়-স্বজনদেরকে মেহেরপুরে প্রেরণ করা হয়। বাসের সাথে বাংলাদেশ স্কাউটসের ২ জন কর্মচারীকে মাইক্রোবাস যোগে প্রেরণ করা হয়। প্রধান জাতীয় কমিশনারের অনুরোধক্রমে শহীদ ৫ রোভারের মৃতদেহ জেলা প্রশাসনের সিনিয়র কর্মকর্তার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অভিভাবকের নিকট হস্তান্তর করা হয়। পরদিন ২৪ অক্টোবর ১৯৯৭ তারিখ শুক্রবার মেহেরপুর সরকারি কলেজ মাঠে তাঁদের জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার নামাজে প্রায় ২০ হাজার স্থানীয় মানুষ শরীক হন। জাতীয় প্রচার মাধ্যম ও পত্র-পত্রিকায় দুর্ঘটনার বিষয়টি ফলাও ভাবে প্রকাশিত হয়। ২৫ অক্টোবর ১৯৯৭ তারিখে ৯ম এশিয়া প্যাসিফিক/৭ম বাংলাদেশ রোভার মুটের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের দিন রাষ্ট্রপতি ও চীফ স্কাউট বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ-এর উপস্থিতিতে এক ভাবগম্ভীর পরিবেশে শোকবার্তা পাঠ করা হয় ও নিহতদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়। এরপর থেকে প্রতি বছর মেহেরপুর জেলা স্কাউট দিবসটি স্থানীয় ‘শহীদ রোভার দিবস’ হিসাবে পালন করে থাকে।